ঋণখেলাপিদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ঋণখেলাপিদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সবার স্বার্থে এ কাজ করতে যাচ্ছি। এর মধ্যে অনেক বিতর্ক হচ্ছে, অনেকে অনেক কথা বলছে, আমরা মাফ করে দিচ্ছি। মাফ কিন্তু সারাবিশ্বেই করা হয়। আমাদের দেশে ক্ষমা করার ব্যবস্থা ছিল না। কারণ এ দেশে দেউলিয়া আইন এবং ব্যাংক আরবিট্রেশন যা আছে, তা কার্যকর ছিল না। সে জন্য একবার ব্যাংকে ঢুকলে সেখান থেকে আর বের হওয়ার পথ ছিল না। আমরা আইনগুলো কার্যকর করে সেই প্রক্রিয়ায় সবাইকে একটা ইকুইটেবল পরিস্থিতি তৈরি করে এখন থেকে মাফ করার ব্যবস্থা করব। বের করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব। সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চালানো যাবে না। আবার সবাইকে মাফও করা যাবে না। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়ে যান, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অ্যাকশন অবশ্যই নিতে হবে। কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।

গতকাল বরিবার একাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরপর্বে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের সম্পূরক প্রশ্নে মন্ত্রী এ কথা বলেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এটা স্বতঃসিদ্ধ, আমরা সবাই জানি যদি ব্যাংকিং খাত স্বাভাবিকভাবে চলতে না পারে এবং যদি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে যায়, আর যদি নন-পারফর্মিং লোনের পরিমাণ বেড়ে যায়, তা হলে আমরা অর্থনীতির গতিশীলতা থেকে বিচ্যুত হবে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ব্যাংক খাতগুলোর রেট অব ইন্টারেস্ট হার কমাব। সুদের হার কমানো না গেলে নন-পারফর্মিং লোন কমবে না।

নন-পারফর্মিং লোন বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, নন-পারফর্মিং লোন তখনই বেড়ে যায়, যখন লোন নিয়ে পরিশোধ করতে পারেন না। নন-পারফর্মিং লোন হওয়ার কারণে সুদের হার অনেক বেশি। যখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা ঋণ পরিশোধ করতে পারে না, তখন সেখানে সঙ্গত কারণেই খেলাপি হয়ে যায়। ঋণখেলাপি রেখে ব্যাংক শিটগুলোর এতটাই দুরবস্থার মধ্যে আছে, সেগুলোকে যদি পরিষ্কার না করি তা হলে আরও খারাপ হয়ে যাবে। সে জন্য সুদের হার মোটামুটি সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আসছি। সেটা নিয়ে আসতে পারলেই সফল হব, আমাদের কর্মসংস্থান বাড়বে। শিল্প-কারখানাগুলো বেঁচে যাবে।

পুঁজিবাজার এখন নিয়ন্ত্রণে নেই

আহসানুল হক টিটুর সম্পূরক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, একটা দেশের অর্থনীতি যতই শক্তিশালী হয়, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই পুঁজিবাজারে। পৃথিবীর সব দেশেই এভাবে পুঁজিবাজার আর অর্থনীতি সম্পৃক্ত থাকে। আমাদের দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত চাঙ্গা, শক্তিশালী। কয়েক দিন আগে আইএমএফের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছি। সেখানেও আমাদের গতিশীলতা দেখে তারা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত। সে সময় আরও যারা মিটিং করেছেন, তারা সবাই বলেছেন বাংলাদেশকে অনুসরণ করার জন্য।

মন্ত্রী বলেন, আমাদের এগিয়ে যাওয়া থমকে যাবে, যদি আমাদের পুঁজিবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি। আমি বলব, পুঁজিবাজার এখন নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই এটা বলব না। পুঁজিবাজারে যেসব সমস্যা আছে, এরই মধ্যে চিহ্নিত করেছি। সবই এক এক করে সমাধান দেব।

তিনি বলেন, আমি আশ্বস্ত করতে পারি সরকার অর্থনৈতিক এলাকায় যেভাবে চিন্তা করে, তেমনি পুঁজিবাজার নিয়েও ততটা যতœশীল। আমি নিজেও পুঁজিবাজারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের সবাইকে নিয়ে এক-দুই দফা মিটিং করেছি, আরও মিটিং করব। মিটিং করে পুঁজিবাজার আরও ১০টি দেশে যেভাবে চলে সেভাবেই চালানোর চেষ্টা করব। আমাদের বিচ্যুতিগুলো অবশ্যই দূর করব।

অপর এক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকবে, অবশ্যই থাকবে। তবে কতটা থাকবে সেটা এ মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন, তা-ই করব।

ব্যাংকিং খাতে নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করতে দোষ নেই ইসরাফিল আলমের এক সম্পূরক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেকের ধারণায় নাজুক অবস্থায় আছে। এটা স্বীকার করতে দোষ নেই। প্রত্যেক দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। একটি উন্নয়নশীল দেশে সব খাতকে সুন্দর ও সমভাবে পরিচালনা করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।

তবে ব্যাংকিং খাত খুব খারাপ করছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ খাত খারাপ করলে বাংলাদেশ বিশ্বের পাঁচটি মাথাপিছু প্রবৃদ্ধি অর্জনের দেশে পরিণত হতে পারত না। সবার ওপরে এখন রয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সমকক্ষ দুটি দেশ। একটি চীন, অন্যটি হচ্ছে ভারত। এই অর্জন ব্যাংককে বাদ দিয়ে হয় না। ব্যাংক একটি বড় এলাকা। আর্থিক খাত ও ব্যাংক খাতকে বাদ দিয়ে এত বড় অর্জন সম্ভব নয়। তার পরও বলব আমাদের রেট অব ইন্টারেস্ট অনেক বেশি। এখানে যে পরিমাণ ইন্টারেস্ট ধরা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা কিন্তু ব্যাংকগুলো পায় না। কয়েক দিন পরপরই এগুলো অবলোপন করতে হয়।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের মতো ১৪-১৫ শতাংশ ঋণের সুদ পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রধানমন্ত্রী সব কিছু বুঝে-শুনে শিল্প ও বাণিজ্য রক্ষা করার জন্য যে সিঙ্গেল ডিজিটের কথা বলেছিলেন সেটিই গ্রহণযোগ্য ছিল। কারণ সিঙ্গেল ডিজিটের ওপরে হলে যিনি ঋণ নিয়েছেন, তিনিও শোধ দিতে পারবেন না। আর যারা দিয়েছেন তারাও পাবেন না। কয়েক দিন পর রাইট অফ করতে হয়। এতে দিনের শেষে দেখা যাবে ৯ শতাংশও পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, সুদের হারের বিষয়টির ওপর কাজ করছি। শিগগিরই সারাবিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক রেট আমরা করব। সেই রেট অব ইন্টারেস্ট বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাসে আর্থিক খাতের জন্য সেটা হবে টার্নিং পয়েন্ট। আর এটা না করতে পারলে বারবার এভাবে রাইট অফের কথা চিন্তা করতে হবে। এতে নন-পারফর্মিং লোন অনেক বেড়ে যাবে। দুর্বল জায়গাগুলো আরও দুর্বল হতে থাকবে। আমরা চাই না সে কাজটি হোক। আমরা এর ওপর কাজ শুরু করেছি। এখন বাস্তবায়নের পালা। ইন্টারেস্ট আমরা কমাব। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত সিঙ্গেল ডিজিটে রাখব।

অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার সুবিধা বিবেচনা করে সুদের হার নির্ধারণ করা হবে। দুই পক্ষেরই উইন উইন ইন্টারেস্ট রেট পুনর্নির্ধারণ করা হবে।

শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ ব্যাংক তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মেয়াদি ঋণ খাতে সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কমানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকগুলো যেন তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী সুদের হার কম করে, সে বিষয়টি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

নতুন নামে ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনা প্রসঙ্গে কাজী ফিরোজ রশীদের সম্পূরক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হোক, সেটা সরকার চায় না। আমরা চাই সবাই ভালোভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের পরিস্থিতি হলে সরকার তার পাশে দাঁড়াবে। যতটা প্রয়োজন সহযোগিতা করবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয়ও এই সুযোগ দেওয়া হয়। আর ফারমার্স ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে এর অর্থ এই নয়Ñ পদ্মা ব্যাংকও ফেল করবে। আমরা আশা করি পদ্মা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। সেজন্য যারা ফার্মাস ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা সেই টাকা পদ্মা ব্যাংক থেকে পাবেন। বিনিয়োগকারীদের সেই অর্থ অবশ্যই ফেরত দেবে।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সম্পূরক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেছেন, শস্যবীমার ইতিবাচক, নেতিবাচক দুইটাই আছে। মাঝে মাঝে দেখতে পাই, তবে সবাইকে দোষ দেব না। মাঝে মাঝে দেখতে পাই কেউ নিজেই নিজের গোডাউনে আগুন লাগিয়ে বিমার দাবি করেন। তাছাড়া শস্যবীমা যদি স্বাভাবিকভাবে দিতে থাকি বা দেই ভয়টা হচ্ছে কৃষক আর কষ্ট করে চাষাবাদ করবে না। আমাদের আমদানি করে ভাত খেতে হবে।

পীর ফজলুর রহমানের সম্পূরক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হ্যাকিং এর মাধ্যমে ১০০ মিলিয়ন ডলারের মতো টাকা পাচার হয়েছে। তার মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার ফেরত পেয়েছি। এখন ৬০ মিলিয়ন ডলারের উপরে পাওয়ার বাকি রয়ে গেছে। এই বিষয়ে একটি মামলা করা হয়েছে। যেহেতু মামলা করেছি, সেটি নিয়ে সংসদে কথা বলা উচিত না।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment